exi gyw³‡hv×v Ave`yj gbœvb
জমিদার আগা বাকেরের নাম অনুসারে বাকেরগঞ্জ নামকরণ হয়। বাকেরগঞ্জের আদি নাম বাকলা ও চন্দ্রদীপ। নামকরণ নিয়ে বহু মতভেদ প্রচলিত আছে। ১৮০১ সালে সদর দপ্তর বাকেরগঞ্জ থেকে বরিশালে স্থানান্তর হয় এবং পূর্ণাঙ্গ বরিশাল জেলা রুপ লাভ করে। হিমালয় পাদদেশে একদা ঢেউ খেলতো। সময়ের ব্যবধানে বহু প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে আজকের এ বিশাল ভু-খন্ড। বরিশাল থেকে এক সময় স্থল পথে হেঁটে ঢাকা যাওয়া যেত। সহস্রাধিক বছরের প্রাচীন বরিশালের কোন অংশ প্রাকৃতিক কারণে নিমজ্জিত হয়েছে সাগরগর্ভে। আবার জেগে উঠেছে সাগরের বুক চিরে। কখনও নদীতে বিলীন হয়ে কখনও আবার নদীর মাঝে চর জেগে ভাঙ্গাগড়ার চিরাচরিত নিয়মে সৃষ্ট বরিশাল শহর-সংলগ্ন ৩ নং চরবাড়িয়া ইউনিয়ন।
বরিশাল জেলা ১০টি উপজেলা নিয়ে গঠিত। বরিশাল সদর উপজেলার অধীন ১০টি ইউনিয়ন। এরই একটি ৩নং চরবাড়িয়া ইউনিয়ন যার আয়তন প্রায় ২০ বর্গমাইল। ৩ নং চরবাড়িয়া ইউনিয়নটি মূলত: বরিশাল শহর-সংলগ্ন তিন দিকে আড়িয়াল খাঁ নদী দ্বারা বেষ্টিত। উত্তরে নদীর ওপার শায়েস্তাবাদ ইউনিয়ন। পূর্বে ও পূর্ব-দক্ষিনে নদী ও নদীর ওপারে চরমোনাই ও চরকাউয়া ইউনিয়ন। দক্ষিণে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন, দক্ষিন দিকের সীমানা নির্দেশক একটি শীর্ণ খাল পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়ে পূর্ব দিকে চরআবদানী মৌজার পার্শ্ব দিয়ে কীর্তনখোলা নদীতে পতিত।
এ খালের উপর দিয়েই তালতলী রোডের সংযোগ মহাবাজ পুল নির্মিত এবং এ পুলের পূর্ব পার্শ্বেই চরবাড়িয়া ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিস। পশ্চিমে কাশিপুর ইউনিয়ন-এর সাথে সংযুক্ত এবং উত্তরে বাবুগঞ্জ থানার চাঁদপাশা ইউনিয়ন।
চিরাচরিত ভাঙ্গাগড়ার নিয়মে নদীবেষ্টিত চরবাড়িয়া ইউনিয়নবাসীদের সামাজিক অবস্থা বরাবরই অসচ্ছল ছিল। গ্রামের অধিবাসীদের অধিকাংশই কৃষিজীবী। চরবাড়িয়া ইউনিয়নের চরবাড়িয়া গ্রামে কৃষক পরিবারে আবদুর রহমান খান ও গৃহিনী মোসা: রাহেলা খাতুন এর ঘরে ১ জুলাই খ্রি : জম্ম গ্রহণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মন্নান। ভারতবর্ষের শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদৌলা বৃটিশ চক্রান্তে সিংহাসনচ্যুত হলে ভারতবর্ষ ২০০ বছর শাসণ করেন বৃট্রিশ সরকার। দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রাম করে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জম্ম লাভ ঘটে। পাকিস্তান দুটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল একটি পশ্চিম পাকিস্তান আর একটি পূর্ব পাকিন্তান। শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী বাঙালীদের শোষন করতে থাকে।
পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা ১৯৫৮ সালে সামরিক বাহিনী দখল করেন। পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারী করায় তার কিছু প্রভাব গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তৎকালীন সামরিক আইন খুব কঠোরভাবে প্রতিপালন করা হতো। শহর পরিস্কার- পরিচ্ছন্ন করা হতো। গ্রামের কচুরিপানা ভর্তি পুকুরগুলোসহ নালা-ডোবা পরিস্কার করা হতো। ১৯৬২ সালে মৌলিক গণতন্ত্রের নামে ৮০,০০০ হাজার বি.ডি মেম্বর নিয়ে গঠিত নির্বাচন মন্ডলীর বিষয়টিও গ্রামে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
১৯৬৫ সনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মার্শল ‘ল প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান ‘গোলাপ ফুল’ এবং ফাতেমা জিন্না ‘হেরিকেন’ মার্কার শ্লোগান গ্রাম মুখরিত হয়। ১৯৬৫ সালে হঠাৎ করে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া শহরে সীমাবদ্ধ না থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। গভর্ণর মোনায়েম খানের দুঃশাসনসহ বিভিন্ন ঘটনাবলী গ্রামে গ্রামে মুখরোচক হিসেবে শোনা যেত । এসব ঘটনাবলী চরবাড়িয়া ইউনিয়নের তালতলি বন্দরে বেশ জাঁকজমকভাবে আলোচিত হতো। শায়েস্তাবাদ, চাঁদপাশাসহ উত্তারাঞ্চলের লোকজন এ বন্দর দিয়ে চলাচল করে বিধায় লোকের সমাগম হতো। বন্দরে কয়েকটি রেডিও’র মাধ্যমে খবর শোনা যেত। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় এ বন্দরেও রাতে হেজাক লাইট জ্বালানো হতো না। কারণ গ্রামেও চলত নিস্প্রদীপ মহড়া।
১৯৬৬ সালে ছয়দফা কর্মসূচী, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯ আইয়ুব বিরোধী গণ আন্দোলন তালতলি তথা চরবাড়িয়া ইউনিয়নে ছড়িয়ে পড়ে। বরিশাল শহর থেকে নেতৃবৃন্দ তালতলি বন্দরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনসভা আহবান করেন। আওয়ামী লীগের নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, আমির হোসেন আমু, আঃ মালেক খান, দেবেন ঘোষ, মহিউদ্দিন আহমেদ, ছাত্রনেতা আ.স.ম ফিরোজ । ন্যাপের রাশেদ খান মেনন, অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী, মজিবুর রহমান, গফুর মোল্লা উল্লেখযোগ্য।
১৯৬৯ সনে ১৫ ফেব্রুয়ারি ক্যান্টনমেন্ট বিচারধীন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত শায়েস্তাবাদের ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক (মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ) গুলিতে আহত হবার বিষয়টি এ অঞ্চলে বেশ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবকে মুক্তির আন্দোলন, চরবাড়িয়া ইউনিয়নে সভা এবং মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। চরবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষক জনাব আবুয়াল ইসলাম খানের নেতৃত্বে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে এলাকায় রাস্তায় রাস্তায় মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং শেখ মুজিবের মুক্তির শ্লোগান প্রদান করা হতো। ‘৬৯-এর গণ আন্দোলনে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহন করা হয় । চরবাড়িয়ায় এ সকল মিছিলে আমি উপস্থিত থাকতাম। চরবাড়িয়ার পার্শ্ববর্তী শায়েস্তাবাদ ইউনিয়ন নিবাসী জনাব আবদুর রহমান বিশ্বাস বৃটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত চরবাড়িয়া বোর্ড স্কুলে পড়াশুনা করেছেন। তিনি পাকিন্তান প্রদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হন এবং পূর্ব পাকিস্থানের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী (শিক্ষা) ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বরিশাল পৌর সভার চেয়ারম্যান, মন্ত্রী, স্পীকার ও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি প্রায়ই শায়েস্তাবাদ নিজ বাড়িতে তালতলি বন্দর দিয়ে যাতায়াত করতেন। তালতলি এলাকার সর্বস্তরের জনসাধারণ রাজনৈতিক কথাবার্তা তার কাছ থেকে শুনতে পেত।
আমার বাড়ি তালতলী বাজার সংলগ্ন হওয়ায় তাদের পিছে পিছে হাটতাম এবং তাদের কথাবার্তা শুনতাম। আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী, নবম সেক্টরের এডজুট্যান্ট, সাবেক এম.পি, আওয়ামীলীগ নেতা ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হকসহ আরো বেশ কিছু নেতৃবৃন্দ তালতলি দিয়ে আসা-যাওয়া করায় এলাকার জণগন তাঁদের কাছ থেকে রাজনৈতিক বিষয় কথাবার্তা শুনতেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময় বহু রাজনীতিবিদ চরবাড়িয়া এসেছেন তাঁদের মধ্যে সর্বজনাব নিরোদ বিহারী নাগ, আমিনুল হক চৌধুরী, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, আমির হোসেন আমু, ডঃ কামাল হোসেন, আবদুর রব সেরনিয়াবাদ, আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। পাকিস্তান শাসকদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন ও ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন চরবাড়িয়ার মানুষের মধ্যে সচেতনতা ফিরে আসে।
১৯৭০ সনে সাধারণ নির্বাচনে জনগণ ভোট প্রদান করে নতুন স্বাদ পায় রাজনৈতিক অঙ্গনে। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ত্বে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ জয় লাভ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি ক্ষমতা ছাড়তে রাজী হলেন না।
পাকিস্তানী শাসনগোষ্ঠি ক্ষমতার দম্ভে একটি সর্বজন স্বীকৃত গণতান্ত্রিক রায়কে অগ্রাহ্য করে একাত্তর সালের পঁচিশ মার্চ দিবাগত রাতে সুপরিকল্পিতভাবে ঢাকায় গণহত্যায় লিপ্ত হয়। পাকিস্তানী জেনারেলগণ বাঙালিদের হত্যা করার লক্ষ্যে “অপারেশণ সার্জ লাইট” পরিকল্পনা তৈরি করে। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নির্দেশে ২৫ মার্চ রাত ১২ টায় পাকিস্তান বাহিনী ঢাকার নিরহ জনগণের উপর হঠাৎ আক্রমন করে। পাকিস্তান বাহিনীর হঠাৎ আক্রমনের সংবাদ পেয়ে শেখ মুজিবর রহমান ২৫ মার্চ রাতেই বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। তার বার্তার মাধ্যমে সব জায়গায় তাঁর ঘোষণা পাঠিয়ে দেন। শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
একাত্তরের ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু হলে ঢাকা থেকে মানুষ দলে দলে ছুটে আসে গ্রাম থেকে গ্রামাঞ্চলে। কিছু পথ হেঁটে, কিছু পথ নৌকায়, কিছু পথ লঞ্চে। বরিশাল অঞ্চলের মানুষ আসতে থাকে লঞ্চ যোগে। বরিশাল শহর থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে চরবাড়িয়া ইউনিয়নের তালতলি বন্দরে আসতে থাকে হাজারও মানুষ। এলাকার উৎসাহী আওয়ামীলীগের নেতাদের নিয়ে গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। তালতলি সংগ্রাম পরিষদের সার্বক্ষণিক দায়িত্ব নিয়োজিত ছিলেন নিবেদিত শতাধিক ছাত্র- যুবক। তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ছিলেন ডাঃ সৈয়দ জাফর আলী, দলিল উদ্দিন হাওলাদার, কাজী হাবিবুর রহমান, মোঃ ইসমাইল হোসেন, আবদুল ওয়াজেদ মিয়া, মোঃ হানিফ হাওলাদার, আবুয়াল ইসলাম খান, জয়নাল মিয়া, আশ্রাব আলী খান, মাজেদ খান। যুবকবৃন্দ হলো- হারুন, জব্বার, দুলাল, সামচু, আলমগীর মল্লিক ও আমি আবদুল মন্নান । সংগ্রাম পরিষদ স্থানীয়ভাবে অর্থ সংগ্রহ করে চিড়া, মুড়ি ও গুড় ক্রয় করে কমিটির সভাপতি ডাঃ সৈয়দ জাফর আলীর ফার্মেসীতে জমা করা হয়। পরে সেগুলো বিভিন্ন পথে আসা শরণার্থীদের ভেতর প্রতিদিন বিতরণ করা হতো। পথ খরচের টাকা দিয়েও সাহায্য করা হতো। অনেককে রাতে থাকার ব্যবস্থাও করা হতো। সংবাদ মাধ্যম ছিলো পানের দোকানদার মোঃ ইসমাইল হোসেন ও চায়ের দোকানদার মোঃ আজাহার খানের ২টি রেডিও মাত্র। খবর শোনার জন্য গ্রামের কৃষকসহ খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ সন্ধ্যায় জমায়েত হতো এই বন্দরে। ইসমাইলের রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান সূচী প্রতিদিন শোনা হতো গোপনে পূর্ব পাশে ইটের ভাটার চৌকিদারের গৃহে বসে । খবরা খবর মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তো সারা ইউনিয়নে।
পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারী করায় তার কিছু প্রভাব গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে তৎকালীন সামরিক আইন খুব কঠোরভাবে প্রতিপালন করা হতো। শহর পরিস্কার- পরিচ্ছন্ন করা হতো। গ্রামের কচুরিপানা ভর্তি পুকুরগুলোসহ নালা-ডোবা পরিস্কার করা হতো।
১৯৬২ সালে মৌলিক গণতন্ত্রের নামে ৮০,০০০ হাজার বি.ডি মেম্বর নিয়ে গঠিত নির্বাচন মন্ডলীর বিষয়টিও গ্রামে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৬৫ সনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মার্শল ‘ল প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান ‘গোলাপ ফুল’ এবং ফাতেমা জিন্না ‘হেরিকেন’ মার্কার শ্লোগান গ্রাম মুখরিত হয়। ১৯৬৫ সালে হঠাৎ করে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া শহরে সীমাবদ্ধ না থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। গভর্ণর মোনায়েম খানের দুঃশাসনসহ বিভিন্ন ঘটনাবলী গ্রামে গ্রামে মুখরোচক হিসেবে শোনা যেত । এসব ঘটনাবলী চরবাড়িয়া ইউনিয়নের তালতলি বন্দরে বেশ জাঁকজমকভাবে আলোচিত হতো। শায়েস্তাবাদ, চাঁদপাশাসহ উত্তারাঞ্চলের লোকজন এ বন্দর দিয়ে চলাচল করে বিধায় লোকের সমাগম হতো। বন্দরে কয়েকটি রেডিও’র মাধ্যমে খবর শোনা যেত। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় এ বন্দরেও রাতে হেজাক লাইট জ্বালানো হতো না। কারণ গ্রামেও চলত নিস্প্রদীপ মহড়া।
১৯৬৬ সালে ছয়দফা কর্মসূচী, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯ আইয়ুব বিরোধী গণ আন্দোলন তালতলি তথা চরবাড়িয়া ইউনিয়নে ছড়িয়ে পড়ে। বরিশাল শহর থেকে নেতৃবৃন্দ তালতলি বন্দরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনসভা আহবান করেন। আওয়ামী লীগের নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, আমির হোসেন আমু, আঃ মালেক খান, দেবেন ঘোষ, মহিউদ্দিন আহমেদ, ছাত্রনেতা আ.স.ম ফিরোজ । ন্যাপের রাশেদ খান মেনন, অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধরী মজিবর রহমান, গফর মোল্লা ১৯৬৯ সনে ১৫ ফেব্রুয়ারি ক্যান্টনমেন্ট বিচারধীন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত শায়েস্তাবাদের ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক (মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ) গুলিতে আহত হবার বিষয়টি এ অঞ্চলে বেশ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবকে মুক্তির আন্দোলন, চরবাড়িয়া ইউনিয়নে সভা এবং মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। চরবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষক জনাব আবুয়াল ইসলাম খানের নেতৃত্বে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে এলাকায় রাস্তায় রাস্তায় মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং শেখ মুজিবের মুক্তির শ্লোগান প্রদান করা হতো। ‘৬৯-এর গণ আন্দোলনে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহন করা হয় । চরবাড়িয়ায় এ সকল মিছিলে আমি উপস্থিত থাকতাম ।
চরবাড়িয়ার পার্শ্ববর্তী শায়েস্তাবাদ ইউনিয়ন নিবাসী জনাব আবদুর রহমান বিশ্বাস বৃটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত চরবাড়িয়া বোর্ড স্কুলে পড়াশুনা করেছেন। তিনি পাকিন্তান প্রদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হন এবং পূর্ব পাকিস্থানের পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী (শিক্ষা) ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বরিশাল পৌর সভার চেয়ারম্যান, মন্ত্রী, স্পীকার ও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি প্রায়ই শায়েস্তাবাদ নিজ বাড়িতে তালতলি বন্দর দিয়ে যাতায়াত করতেন। তালতলি এলাকার সর্বস্তরের জনসাধারণ রাজনৈতিক কথাবার্তা তার কাছ থেকে শুনতে পেত। আমার বাড়ি তালতলী বাজার সংলঘ্ন হওয়ায় তাদের পিছে পিছে হাটতাম এবং তাদের কথাবার্তা শুনতাম।
আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী, নবম সেক্টরের এডজুট্যান্ট, সাবেক এম.পি, আওয়ামীলীগ নেতা ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হকসহ আরো বেশ কিছু নেতৃবৃন্দ তালতলি দিয়ে আসা-যাওয়া করায় এলাকার জণগন তাঁদের কাছ থেকে রাজনৈতিক বিষয় কথাবার্তা শুনতেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময় বহু রাজনীতিবিদ চরবাড়িয়া এসেছেন তাঁদের মধ্যে সর্বজনাব নিরোদ বিহারী নাগ, আমিনুল হক চৌধুরী, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, আমির হোসেন আমু, ডঃ কামাল হোসেন, আবদুর রব সেরনিয়াবাদ, আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। পাকিস্তান শাসকদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন ও ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন চরবাড়িয়ার মানুষের মধ্যে সচেতনতা ফিরে আসে।
১৯৭০ সনে সাধারণ নির্বাচনে জনগণ ভোট প্রদান করে নতুন স্বাদ পায় রাজনৈতিক অঙ্গনে। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ জয় লাভ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি ক্ষমতা ছাড়তে পাকিস্তানী শাসনগোষ্ঠি ক্ষমতার দম্ভে একটি সর্বজন স্বীকৃত গণতান্ত্রিক রায়কে অগ্রাহ্য করে একাত্তর সালের পঁচিশ মার্চ দিবাগত রাতে সুপরিকল্পিতভাবে ঢাকায় গণহত্যায় লিপ্ত হয়। পাকিস্তানী জেনারেলগণ বাঙালিদের হত্যা করার লক্ষ্যে “অপারেশণ সার্জ লাইট” পরিকল্পনা তৈরি করে। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নির্দেশে ২৫ মার্চ রাত ১২ টায় পাকিস্তান বাহিনী ঢাকার নিরহ জনগণের উপর হঠাৎ আক্রমন করে। পাকিস্তান বাহিনীর হঠাৎ আক্রমনের সংবাদ পেয়ে শেখ মুজিবর রহমান ২৫ মার্চ রাতেই বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। তার বার্তার মাধ্যমে সব জায়গায় তাঁর ঘোষণা পাঠিয়ে দেন। শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
একাত্তরের ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু হলে ঢাকা থেকে মানুষ দলে দলে ছুটে আসে গ্রাম থেকে গ্রামাঞ্চলে। কিছু পথ হেঁটে, কিছু পথ নৌকায়, কিছু পথ লঞ্চে। বরিশাল অঞ্চলের মানুষ আসতে থাকে লঞ্চ যোগে। বরিশাল শহর থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে চরবাড়িয়া ইউনিয়নের তালতলি বন্দরে আসতে থাকে হাজারও মানুষ। এলাকার উৎসাহী আওয়ামীলীগের নেতাদের নিয়ে গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ।
তালতলি সংগ্রাম পরিষদের সার্বক্ষণিক দায়িত্ব নিয়োজিত ছিলেন নিবেদিত শতাধিক ছাত্র- যুবক। তাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ছিলেন ডাঃ সৈয়দ জাফর আলী, দলিল উদ্দিন হাওলাদার, কাজী হাবিবুর রহমান, মোঃ ইসমাইল হোসেন, আবদুল ওয়াজেদ মিয়া, মোঃ হানিফ হাওলাদার, আবুয়াল ইসলাম খান, জয়নাল মিয়া, আশ্রাব আলী খান, মাজেদ খান। যুবকবৃন্দ হলো- হারুন, জব্বার, দুলাল, সামচু, আলমগীর মল্লিক ও আমি আবদুল মন্নান । সংগ্রাম পরিষদ স্থানীয়ভাবে অর্থ সংগ্রহ করে চিড়া, মুড়ি ও গুড় ক্রয় করে কমিটির সভাপতি ডাঃ সৈয়দ জাফর আলীর ফার্মেসীতে জমা করা হয়। পরে সেগুলো বিভিন্ন পথে আসা শরণার্থীদের ভেতর প্রতিদিন বিতরণ করা হতো। পথ খরচের টাকা দিয়েও সাহায্য করা হতো। অনেককে রাতে থাকার ব্যবস্থাও করা হতো।
সংবাদ মাধ্যম ছিলো পানের দোকানদার মোঃ ইসমাইল হোসেন ও চায়ের দোকানদার মোঃ আজাহার খানের ২টি রেডিও মাত্র। খবর শোনার জন্য গ্রামের কৃষকসহ খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ সন্ধ্যায় জমায়েত হতো এই বন্দরে। ইসমাইলের রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান সূচী প্রতিদিন শোনা হতো গোপনে পূর্ব পাশে ইটের ভাটার চৌকিদারের গৃহে বসে । খবরা খবর মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তো সারা ইউনিয়নে।
ঢাকার সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বিছিন্ন ছিলো ২৫ মার্চের পর। ঢাকার সাথে মাঝে মাঝে টেলিফোনে যোগাযোগ হতো। প্রতিদিনের খবর পাওয়া যেত সন্ধ্যায় শহর থেকে আগত ব্যক্তিদের কাছ থেকে। খবর নিয়ে প্রতিটি দোকানে আলোচনা-সমালোচনা হতো। রাতেই যশোর থেকে পাকবাহিনী বরিশাল আসবে। স্থল পথে যশোর থেকে আসতে হলে ২/৩টি ভেরি পারাপার করে আসতে হবে। তাই দোয়ারিকা ও শিকারপুরের ফেরী সরিয়ে রাখা হয়েছে, পাকিস্তানের সৈন্যরা আসতে পারবে না। আবার শোনা যেত কালকেই নদী পথে বরিশাল সেনাবাহিনী আসছে। প্রতিদিন এসব গুজব শুনে তালতলি আসেপাশের এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হতে থাকে। উৎসাহী ও বিজ্ঞ ব্যক্তিদের নির্দেশে আত্মরক্ষার জন্য এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ট্রেন্স খনন করা হয়। সংবাদ পাওয়া গেল বরিশাল স্ট্রীমারঘাটে খুলনা থেকে আসা একজন পাকিস্তানী চর ওয়ারলেসসহ আটক করা হয়েছে। অস্থায়ী সামরিক বিচারে ঘোষণা করা হয়েছে তাকে চাঁদমারীতে প্রকাশ্য জনসমুক্ষে গুলী করে হত্যা করা হবে। মেজর জলিলের নির্দেশে হাজার হাজার লোকের উপস্থিতিতে ১৭ এপ্রিল’৭১-এ ফায়ারিং করে উক্ত এজেন্টকে হত্যা করা হয় ।
১৮ এপ্রিল দু’টি যুদ্ধের বিমান বরিশাল শহরে রকেট ও মেশিনগানের গুলী বর্ষণ করে। যুদ্ধ বিমানের প্রকট শব্দ ও গোলাগুলি শব্দে ভয়ে মানুষের ছুটাছুটিতে বহু লোক আহত হয়। কীর্তনখোলা নদীতে একটি লঞ্চে বোমা পড়ে, লঞ্চটিতে আগুন ধরে যায় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে লঞ্চটি ডুবে যায়। বোমারু বিমানের নিক্ষিপ্ত গুলিতে বেল্স পার্কে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু উদ্যান)আবদুল গনি নামে এক ব্যক্তি মারা যায়। চাঁদমারী মাঠে একটি গরু মারা যায়। পুলিশ লাইন ও স্টীমার ঘাটের মসজিদে গুলির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বার বার উপর দিয়ে বিমান উড়ে যাবার সময় বিমান থেকে গুলি, বোমা নিক্ষেপে মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। সেদিন বিকেল থেকেই শহরের মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দূরবর্তী গ্রামাঞ্চলে চলে যেতে থাকে। তালতলি পশ্চিম পাশে নদীতে হোগলপাতা বন ছিল। জঙ্গী বিমানের গুলি ও বোমা থেকে বাঁচার জন্য বন্দরের অনেকের সাথে লেখকও সেদিন ঐ হোগল পাতা বনের মাঝে পানিতে লুকিয়ে আশ্রয় নিয়ে ছিলো।
বোমারু বিমান ২টি পুনরায় ২০ এপ্রিল কোন গোলা বর্ষণ না করে শহরের নিচু দিয়ে বার বার উড়ে যায়। ফলে পুরো শহরটাই জনশূন্য হয়ে পড়ে। চরবাড়িয়া ইউনিয়নের তালতলি এলাকার প্রায় সকল পরিবারের ছেলে-মেয়েসহ মহিলা সদস্যরা তাদের দূরবর্তী আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তালতলি এলাকার
সকল বাড়িতেই ট্রেন্স খনন করা হয়। পাকিস্তানী সেনাদের তালতলি আসা রুখতে তালতলি বাজারের দক্ষিণ পাশের রাস্তা কেটে শহরে গাড়ি যাতায়াতের পথ বিচ্ছিন্ন করা হয় ।
বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণা বার্তা ২৬ মার্চ ওয়ার্লেসের মাধ্যমে বরিশাল পৌঁছে। ২৭ তারিখ মেজর জলিল উজিরপুর থেকে বরিশাল আসেন। তিনি এসে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দদের নিয়ে বরিশাল সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।
বরিশালে মেজর জলিলের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী সংগটিত হয়। বরিশাল সদর গালস্ স্কুলে সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। মেজর জলিল বরিশাল মহিলা কলেজে থাকতেন এবং মহিলা কলেজে সামরিক ঘাঁটির দপ্তর ছিলো। বিভিন্ন স্থানে ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করা হয়। দু’ থেকে আড়াইশ মুক্তিবাহিনী নিয়ে চরবাড়িয়া ইউনিয়নের উলালঘুনী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (নাজির বাড়ি) চালু করা হয় মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প। যার পরিচালনায় ছিলেন ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক, লেঃ ইমাম আল মেহেদি এবং হাবিলদার পঞ্চনন গাজী। আমি ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। অবসর প্রাপ্ত পুলিশ সদস্য হাতেম আলী হাওলাদার ও আনসার বাহিনীর সদস্য দিয়ে তালতলি ইটের ভাটায় ও চরবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কিছু দিন প্রশিক্ষণ চালু ছিল। শায়েস্তাবাদ স্কুলে ট্রেনিং পরিচালনা করে হবিনগর নিবাসী আনসার কমান্ডার আবদুল ওয়াজেদ হাওলাদার।
ঢাকা থেকে নদী পথে পাকিস্তান বাহিনীর আগমন প্রতিহত করার জন্য শহর থেকে ৫ মাইল দূরে ঝুনাহারের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে ঝুনাহার ক্রসিং সামনে রেখে উত্তর লামচরী ফকিরবাড়ির সম্মুখে রাস্তার পাশে বাঙ্কার তৈরী করা হয় এবং শায়েস্তাবাদ রাজাপুর ও হবিনগরেও বাঙ্কার তৈরী করা হয়। উত্তর লামচরীর ফকিরবাড়ির কাচারি ঘর এবং গাজীবাড়ির কাচারি ঘরে মুক্তিযোদ্ধারা সার্বক্ষনিকভাবে অবস্থান নেয়। কাচারি ঘর ২টি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ক্যাম্প হিসেবে পরিচালিত হতো। মেজর জলিলের নেতৃত্বে বরিশাল পুলিশ লাইন থেকে রাইফেলস ও হালকা অস্ত্র তালতলি নিয়ে আসে। আমরা অস্ত্রগুলো স্পীড বোর্ডে তুলে দেই। ঝুনাহারে এ সকল অস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনী বাঙ্কারে অবস্থান নেয়। ঝুনাহারের সংযোগ স্থলের দু’পাশে ইরানী ও মাঝভী নামের দু’টি স্টীমার নোঙ্গর করে রাখা হয়। এসব স্টীমারে স্থাপন করা হয় আইডব্লিউটিএ-এর ১টি ওয়ারল্সে। সমগ্র বরিশাল ছিলো মুক্তিবাহিনীর অধীনে। মেজর এম.এ জলিল একটি জীপ গাড়ীতে প্রায়ই তালতলিতে এসে স্পীড বোটে ঐ নার
ঢাকার সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বিছিন্ন ছিলো ২৫ মার্চের পর।
ঢাকার সাথে মাঝে মাঝে টেলিফোনে যোগাযোগ হতো। প্রতিদিনের খবর পাওয়া যেত সন্ধ্যায় শহর থেকে আগত ব্যক্তিদের কাছ থেকে। খবর নিয়ে প্রতিটি দোকানে আলোচনা-সমালোচনা হতো। রাতেই যশোর থেকে পাকবাহিনী বরিশাল আসবে। স্থল পথে যশোর থেকে আসতে হলে ২/৩টি ভেরি পারাপার করে আসতে হবে। তাই দোয়ারিকা ও শিকারপুরের ফেরী সরিয়ে রাখা হয়েছে, পাকিস্তানের সৈন্যরা আসতে পারবে না। আবার শোনা যেত কালকেই নদী পথে বরিশাল সেনাবাহিনী আসছে। প্রতিদিন এসব গুজব শুনে তালতলি আসেপাশের এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হতে থাকে। উৎসাহী ও বিজ্ঞ ব্যক্তিদের নির্দেশে আত্মরক্ষার জন্য এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ট্রেন্স খনন করা হয়। সংবাদ পাওয়া গেল বরিশাল স্ত্রীমারঘাটে খুলনা থেকে আসা একজন পাকিস্তানী চর ওয়ারলেসসহ আটক করা হয়েছে। অস্থায়ী সামরিক বিচারে ঘোষণা করা হয়েছে তাকে চাঁদমারীতে প্রকাশ্য জনসমুক্ষে গুলী করে হত্যা করা হবে। মেজর জলিলের নির্দেশে হাজার হাজার লোকের উপস্থিতিতে ১৭ এপ্রিল’৭১-এ ফায়ারিং করে উক্ত এজেন্টকে হত্যা করা হয় ।
১৮ এপ্রিল দু’টি যুদ্ধের বিমান বরিশাল শহরে রকেট ও মেশিনগানের গুলী বর্ষণ করে। যুদ্ধ বিমানের প্রকট শব্দ ও গোলাগুলি শব্দে ভয়ে মানুষের ছুটাছুটিতে বহু লোক আহত হয়। কীর্তনখোলা নদীতে একটি লঞ্চে বোমা পড়ে, লঞ্চটিতে আগুন ধরে যায় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে লঞ্চটি ডুবে যায়। বোমারু বিমানের নিক্ষিপ্ত গুলিতে বেল্স পার্কে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু উদ্যান)আবদুল গনি নামে এক ব্যক্তি মারা যায়। চাঁদমারী মাঠে একটি গরু মারা যায়। পুলিশ লাইন ও স্টীমার ঘাটের মসজিদে গুলির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বার বার উপর দিয়ে বিমান উড়ে যাবার সময় বিমান থেকে গুলি, বোমা নিক্ষেপে মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। সেদিন বিকেল থেকেই শহরের মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দূরবর্তী গ্রামাঞ্চলে চলে যেতে থাকে।
তালতলি পশ্চিম পাশে নদীতে হোগলপাতা বন ছিল। জঙ্গী বিমানের গুলি ও বোমা থেকে বাঁচার জন্য বন্দরের অনেকের সাথে লেখকও সেদিন ঐ হোগল পাতা বনের মাঝে পানিতে লুকিয়ে আশ্রয় নিয়ে ছিলো।
বোমারু বিমান ২টি পুনরায় ২০ এপ্রিল কোন গোলা বর্ষণ না করে শহরের নিচু দিয়ে বার বার উড়ে যায়। ফলে পুরো শহরটাই জনশূন্য হয়ে পড়ে। চরবাড়িয়া ইউনিয়নের তালতলি এলাকার প্রায় সকল পরিবারের ছেলে-মেয়েসহ মহিলা সদস্যরা তাদের দূরবর্তী আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তালতলি এলাকার সাকল বাড়িতেই ট্রেন্স খনন করা হয়। পাকিস্তানী সেনাদের তালতলি আসা রুখতে তালতলি বাজারের দক্ষিণ পাশের রাস্তা কেটে শহরে গাড়ি যাতায়াতের পথ বিচ্ছিন্ন করা হয় ।
বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণা বার্তা ২৬ মার্চ ওয়ার্লেসের মাধ্যমে বরিশাল পৌঁছে। ২৭ তারিখ মেজর জলিল উজিরপুর থেকে বরিশাল আসেন। তিনি এসে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দদের নিয়ে বরিশাল সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।
বরিশালে মেজর জলিলের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী সংগটিত হয়। বরিশাল সদর গালস্ স্কুলে সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। মেজর জলিল বরিশাল মহিলা কলেজে থাকতেন এবং মহিলা কলেজে সামরিক ঘাঁটির দপ্তর ছিলো। বিভিন্ন স্থানে ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করা হয়। দু’ থেকে আড়াইশ মুক্তিবাহিনী নিয়ে চরবাড়িয়া ইউনিয়নের উলালঘুনী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (নাজির বাড়ি) চালু করা হয় মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প। যার পরিচালনায় ছিলেন ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক, লেঃ ইমাম আল মেহেদি এবং হাবিলদার পঞ্চনন গাজী। আমি ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। অবসর প্রাপ্ত পুলিশ সদস্য হাতেম আলী হাওলাদার ও আনসার বাহিনীর সদস্য দিয়ে তালতলি ইটের ভাটায় ও চরবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কিছু দিন প্রশিক্ষণ চালু ছিল। শায়েস্তাবাদ স্কুলে ট্রেনিং পরিচালনা করে হবিনগর নিবাসী আনসার কমান্ডার আবদুল ওয়াজেদ হাওলাদার।
ঢাকা থেকে নদী পথে পাকিস্তান বাহিনীর আগমন প্রতিহত করার জন্য শহর থেকে ৫ মাইল দূরে ঝুনাহারের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে ঝুনাহার ক্রসিং সামনে রেখে উত্তর লামচরী ফকিরবাড়ির সম্মুখে রাস্তার পাশে বাঙ্কার তৈরী করা হয় এবং শায়েস্তাবাদ রাজাপুর ও হবিনগরেও বাঙ্কার তৈরী করা হয়। উত্তর লামচরীর ফকিরবাড়ির কাচারি ঘর এবং গাজীবাড়ির কাচারি ঘরে মুক্তিযোদ্ধারা সার্বক্ষনিকভাবে অবস্থান নেয়। কাচারি ঘর ২টি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ক্যাম্প হিসেবে পরিচালিত হতো। মেজর জলিলের নেতৃত্বে বরিশাল পুলিশ লাইন থেকে রাইফেলস ও হালকা অস্ত্র তালতলি নিয়ে আসে। আমরা অস্ত্রগুলো স্পীড বোর্ডে তুলে দেই।
ঝুনাহারে এ সকল অস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনী বাঙ্কারে অবস্থান নেয়। ঝুনাহারের সংযোগ স্থলের দু’পাশে ইরানী ও মাঝভী নামের দু’টি স্টীমার নোঙ্গর করে রাখা হয়। এসব স্টীমারে স্থাপন করা হয় আইডব্লিউটিএ-এর ১টি ওয়ারল্সে। সমগ্র বরিশাল ছিলো মুক্তিবাহিনীর অধীনে। এসে স্পীড বোটে ঐ
মেজর এম.এ জলিল একটি জীপ গাড়ীতে পরার শাল ছিলো।
সব স্থান পরিদর্শন করতেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতেন। তখন তাঁর কাঁধে থাকত একটি চায়নিজ রাইফেল।
ফুকির বাড়ি কাচারী বা
মুক্তিযোদ্ধ
ম্পিছিল
একাত্তরের ২৫ এপ্রিল এ দিনটির কথা ভাবতে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আর মনে পড়ে সেই ভয়াল বিভীষিকাময় দিনটির কথা। বরিশাল দখলে পাকিস্তান বাহিনীর বর্বর হামলায় সেদিন আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শী বীর মুক্তিযোদ্ধা। সেদিন জীবনটা যেতেও রয়ে গেছে কোন রকমের। ভাবতে অবাক লাগে আমি বেঁচে থাকব, বেঁচে আছি। এখনও মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয় না। একি সত্যি, স্বপ্ন, না কোন ঘোরের মধ্যে সে সময়টা কাটিয়েছি।
১৯৭১ সালে আমি দশম শ্রেণির একজন ছাত্র ছিলাম। সে দিন চরবাড়িয়া হয়ে উঠেছিল এক রক্তাক্ত ভূমি। রক্তাক্ত ভুমির স্মৃতি হাতড়ে এখনো বহু মানুষ যুদ্ধকালীন বীভৎস ট্রাজেডি নিয়ে বেঁচে আছেন। তাদের সেদিনকার সেই জীবনদান নিয়ে হয়নি কোন অনুসন্ধানী রিপোর্ট, মেলেনি কোন সরকারি স্বীকৃতি এবং পায়নি কোন সহায়তা। পাকিস্তান বাহিনীর হাতে আমার পিতা আবদুর রহমান খান ও পিতামহ মুন্সী আলী আজিম খান শহীদ হয়েছেন।
বরিশালবাসী আতঙ্কের মধ্যে ১টি মাস কাটায়। বরিশাল মুক্ত এলাকা হিসেবে ঘোষনা করা হয়। ২৫ এপ্রিল সকালে সংবাদ এলো ঢাকা থেকে গানবোট করে পাকিস্তানী সৈন্যরা বরিশালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। নন্দিবাজার পর্যন্ত গানবোটগুলো পৌঁছে গেছে। এ সংবাদ শোনা মাত্র তালতলি এলাকার লোকজনের মধ্যে ভীষন আতঙ্গ সৃষ্টি হয়।
বিনা বাঁধায় পাকিস্তান বাহিনী ৩টি গানবোট আস্তে আস্তে ঝুনাহার নদী দিয়ে শায়েস্তাবাদ ও চরবাড়িয়া অতিক্রম করছিলো। ঠিক তখনি শায়েস্তাবাদ ও চরবাড়িয়া অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা গানবোট লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে। মুহূর্তের মধ্যে গানবোট থেকে প্রচন্ড শব্দে মর্টার ও মেশিন গানের গুলি এবং সেল মারতে থাকে। চতুর্দিকে শুধু গগন বিদায়ী টর-টর-টর শব্দ আর মাঝে মধ্যে সে শব্দ ছাপিয়ে গুর- গুর-গুরুম শব্দ চলতে থাকে। গানবোট থেকে শায়েস্তাবাদ ও চরবাড়িয়া গ্রামাঞ্চলে মেশিনগানের গোলা বর্ষণ করতে থাকে। প্রচন্ড গোলার আঘাতে ইরানী ও মাঝভী নামের স্টীমার দু’টি ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। পানি উঠে আস্তে আস্তে স্টীমার ২টি ডুবে যায়। ডুবে যাওয়া স্থানে চর পরে যাওয়ায় শুধু স্টীমারে চুঙ্গা ২টি পানির উপরে দেখা যেত। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গানবোট ঘায়েল করার মত কোন অস্ত্র ছিলো না। ভারী অস্ত্রের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন দিকে ছুটে যেতে বাধ্য হয়। ববর্র পাকিস্তান বাহিনীর আঘাতে মুক্তিবাহিনীর বাঙ্গার গুলো ধ্বংস হয়ে যায়।
পাকিস্তান বাহিনীর ধারণা ছিলো বরিশাল মুক্তিবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি রয়েছে। ঝুনাহারে বাঁধার সম্মুখীন হলে চরবাড়িয়াকে প্রাথমিক অপারেশনের স্পট হিসেবে বেছে নেয়। বর্বর চৌকষ পাকিস্তানী বাহিনীর নিকট তালতলি ও চরবাড়িয়া এলাকার ম্যাপ ছিল এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্পের বিস্তারিত বিবরণ ছিল। ঠিক সে মোতবেক বাধাপ্রাপ্ত হয়েই পাকিস্তানী সৈন্যরা ঢাকায় যোগাযোগ করে। আধা ঘন্টার মধ্যে ২টি হেলিকাপ্টার করে ছত্রি সৈন্য তালতলি এসে পৌছে। হেলিকাপ্টার ২টি জঙ্গী বিমান পাহাড়া দিয়ে নিয়ে আসে। তালতলির পূর্বপার্শ্বে ত্রিফল আচ্ছাদিত মাঠে ছত্রি সৈন্যদের নামিয়ে দেয়। এমনি ভাবে তিন তিনবার হেলিকাপ্টার থেকে ছত্রি সৈন্য নামানো হয় ।
জল, স্থল ও বোমারু বিমান নিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা শক্তি বৃদ্ধি করে তিনটি গানবোট নিয়ে তালতলি বন্দরের দুই পাশ দিয়ে আক্রমন শুরু করে। তালতলি পূর্বপাশে হাওলাদার বাড়ির সম্মুখে একটি। তালতলি পশ্চিম পার্শ্বে আমার পিতা শহীদ আবদুর রহমান খানের বাড়ির সম্মুখে একটি। অন্যটি আরো পশ্চিমে পার্শ্বে আমার দাদা শহীদ মুন্সী আলী আজিম খানের বাড়ির সম্মুখে নোঙ্গর করে। গানবোট থেকে ভারী অস্ত্রসহ সেনাবাহিনী স্থল ভাগে নেমে যায়। যাকেই সামনে পেয়েছে তাকেই গুলি করে হত্যা করেছে। ক্রোলিং করে সম্মুখে এগুবার পথে সারাক্ষণ প্রচন্ড গুলি বর্ষণ করতে থাকে। গানবোট থেকেও সৈন্য সারাক্ষণ প্রচন্ড শব্দে গোলা বর্ষণ করতে থাকে। ৫/৬ মাইল দূরে গিয়েও এসব গোলার অগ্নিকুন্ডু ও স্কুলিং পড়তে থাকে। বাড়ি বাড়ি যেয়ে যেখানে যাকে পেয়েছে তাকেই নৃসংশভাবে হত্যা করেছে। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধাকে রেহাই দেয়নি।
মেশিনগানের গোলার প্রচন্ড শব্দ এবং গুলির ভয়ে চরবাড়িয়া এলাকার লোকজন সবকিছু ফেলে পশ্চিম দিকে দৌড়ে চলে যায়। পূর্ব দিকে কিছু সংখ্যক লোক নদীতে সাঁতার কেটে ওপার উঠে নিরাপদ আশ্রয় নেন। কেউ কেউ পার্শ্ববর্তী গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়। বর্বর বাহিনী শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে গৃহে আগুন ধরিয়ে দিলে আগুনের লেলিহান শিখা দূর থেকে দেখা যায়। শত শত খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে এলাকায় ভীষন ত্রাসের সৃষ্টি করে।
চৌকস পাকিস্তান বাহিনী বরিশাল তাদের দোসরদের মাধ্যমে প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতে মহাবাজের নাজিরবাড়ির মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমন করার জন্য অগ্রসর হতে থাকে। অবশেষে মুক্তিবাহিনী ২ঘন্টা লড়াই করে পিছু হটে যায়। পাকিস্তান বাহিনী চরবাড়িয়া, রাড়ীমহল, উলালঘুনি, চর উলালঘুনী, সাপানিয়া, কাগাশুরা, পুরানপাড়া হয়ে শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। যুদ্ধে ঝুনাহারে মুক্তিবাহিনীর পতন ঘটায় মুক্তিবাহিনী এলাকা ত্যাগ করার পরও পাকিস্তান বাহিনী ঝুনাহার অতিক্রম করার সাহস পায়নি। মুক্তিযোদ্ধাগণ অনেক অস্ত্রসহ কমিশনারচর ও বাবুগঞ্জ গিয়ে আশ্রয় নেয়। চরবাড়িয়া এলাকা একেবারই জনশূন্য হয়ে যায়। এ যেন এক প্রলয়ংকরী হত্যাযজ্ঞ যা চোখে না দেখলে অনুধাবন করা যায় না।
সারাদিন হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর বেলাশেষে কিছুটা নিস্ক্রিয় হয়ে পরে। তখন মুসলমানিত্ব প্রমানের জন্য দিগম্বর করে দেখত। আবার কাউকে কলেমা পাঠের শুদ্ধতা দিয়ে যাচাই করে সৈন্যদের মন মতো হলেই হত্যা থেকে রেহাই দেয়া হতো। হঠাৎ করে প্রচন্ড গোলাবর্ষণ, সেল ও মর্টারের প্রচন্ড শব্দে উত্তেজিত, উৎকণ্ঠিত এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় এলাকার লোকজন দৌঁড়ে সরে গেলেও কিছু কিছু লোক পরিবার-পরিজনকে নিয়ে ট্রেন্সে ও ঘরে আশ্রয় নিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলেও পাকিস্তানী বাহিনীর হত্যালীলা থেকে রেহাই পেল না শিশু, মহিলাসহ আবাল-বৃদ্ধা-বনিতা অনেকেই ।
চরবাড়িয়ার যোদ্ধারা ঝুনাহারে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় চরবাড়িয়ায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ঘটায়। ৮ মাসের শিশু, ৯০ বছরের বৃদ্ধা, মসজিদের ইমাম, ১০ জন মহিলা, ৬টি শিশুসহ ৪৭ জন মুক্তিকামী জনতা শহীদ হন। আহত হয় ২৪ জন এবং অসংখ্য বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়। চরবাড়িয়ার ঐশ্বর্য বীর্যবান ও দেশপ্রেমিক সাধারণ বাসিন্দারা ২৫ এপ্রিল ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে রেখে গেছে স্বাধীনতার ইতিহাসে গ্রামীন জনপদের নতুন অবদান।
ঐদিন মিলিটারি আর বরিশাল প্রবেশ না করে তালতলির পূর্ব পাশে হাওলাদার বাড়ির সম্মুখে গানবোট ও সাদা লঞ্চটি এক জায়গায় হয়ে একত্রে রাত্রিযাপন করেন। পরের দিন গানবোটগুলো বরিশাল শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পথিমধ্যে চরমোনাই উঠে অসংখ্যক বাড়ি-ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তারপর আস্তে আস্তে বরিশাল শহরে লঞ্চ ঘাঁটে পৌঁছলে আদম আলীসহ বেশ কিছু মুসলিম লীগের লোকজন পাকিস্তানী পতাকা নিয়ে পাকিস্তান সৈন্যদের অভ্যর্থণা জানান।
বরিশাল শহর পাকিস্তান বাহিনীর দখলে চলে যান। শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়াপদা কলোণীতে অবস্থান করেন। একাত্তরের এপ্রিল-মে মাস থেকে ঘটনাপ্রবাহের দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এপ্রিল মাসে মুজিবনগর সরকার সমগ্র রণাঙ্গনকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে বরিশাল জেলাকে ৯ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভূক্ত করে। বরিশাল জেলার বাসিন্দা মেজর জলিলকে ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
১১টি সেক্টরের অন্যতম ৯ নম্বর সেক্টর যার ভৌগোলিক অবস্থা বিশেষ কয়েকটি কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাবুগঞ্জের আবদুল ওহাব খানকে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নিয়োগ করায় তিনি প্রায়ই নৌকাযোগে আমাদের বাড়ির সামনের ঘাটে আসতেন এবং তিনি চরবাড়ীয়া ইউনিয়ন তালতলী বাজারের পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত প্যাথলজি বিভাগের বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ সৈয়দ জাফর আলীর সাথে যোগাযোগ করতেন। তাকে কমান্ডার আবদুল ওহাব খান তার ক্যাম্পে যেতে বলতেন। সাপানিয়া নিবাসী রিকসার চালক জয়নাল আবেদীন ও আমি সার্বক্ষনিক তার সাথে কাজ করেছি।
অক্টোবর মাস পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিপুল সংখ্যক অফিসারসহ কয়েক হাজার সেনা নিহত ও আহত হন। নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এমন একটা অবস্থা বিরাজ করছিলো যখন সন্ধ্যার পর কোন ব্যাংকার বা ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানী সেনাদের বাইরে আসা দুরহ হয়ে পড়ে। বরিশাল এলাকাতে দিনের বেলাতেও পাকিস্তানী সেনাদের যাতায়াত প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
৯ নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা তুমুল যুদ্ধ করে বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার থানা সমূহ মুক্ত করতে থাকে। প্রচন্ড আক্রমনের ফলে ১৬ নভেম্বরের মধ্যে প্রায় সব থানা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। ৩০ নভেম্বরের পর পাকবাহিনী শুধু নিজ নিজ ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান নেন। ৩ ডিসেম্বর শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ।
যশোর ও খুলনা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমনের মুখে অনেক পাক সেনা পলায়ন করে লঞ্চযোগে বরিশাল এসে ওয়াপদা কলোনীতে আশ্রয় নেন। কয়েকজন থানা কমান্ডার বরিশাল শহরের চারিদিকে অবস্থান নেন।
ডাঃ সৈয়দ জাফর আলীর সাথে প্রায় সকল কমান্ডারদের নিয়মিত যোগাযোগ হতো। এ খবর ওয়ারলেসের মাধ্যমে পৌছে যায় মিত্রবাহিনীর কাছে। মিত্রবাহিনী ৬ ও ৭ ডিসেম্বর রহমতপুর বিমান ঘাঁটিতে দু’টি বোমারু বিমান ব্যাপক বোমা বর্ষণ করে বিমান ঘাঁটি অকেজো
করে দেয় ।
৮ ডিসেম্বর সকালে হঠ্যাৎ করে বরিশাল শহরে কার্টু ঘোষণা করে। বরিশাল ওয়াপদা কলোণী থেকে সকল সেনা কয়েকটি লঞ্চযোগে বেলা ১১টায় স্টীমার ঘাট ত্যাগ করে। শান্তিবাহিনীর কয়েকজন উর্ধতন সদস্য এ লঞ্চযোগে পালিয়ে যান। বরিশাল স্টীমার ঘাট হতে লঞ্চগুলো ছেড়ে যাবার পরই শহরের কার্টু শিথিল হয়। নিকটবর্তী মুক্তিযোদ্ধারা শহরে এসে পরে এবং শহরবাসী জানতে পারে পাক সেনারা বরিশাল থেকে পালিয়ে ঢাকা অভিমুখে রওয়ানা হয়েছে। এ সংবাদে ঘর থেকে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এবং জয়বাংলা স্লোগানে শহর মুখরিত করে তুলে। এ সংবাদটি বরিশালের মুক্তিযোদ্ধারা ওয়ারলেসের মাধ্যমে মিত্রবাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয় ।
বর্বর পাকবাহিনী লঞ্চগুলো আস্তে আস্তে চরবাড়িয়া ও শায়েস্তাবাদ হয়ে মীরগঞ্চ অতিক্রম করতে থাকে। যে পথে ২৫ এপ্রিল ঢাকা থেকে বরিশাল আক্রমন করে ছিলো ঠিক একই পথ ধরে পালিয়ে যেতে থাকে। মীরগঞ্চ থেকে একটু সামনে এগুতেই মিত্রবাহিনীর বোমারু বিমান লঞ্চগুলো লক্ষ্য করে বোমা ও গুলী বর্ষণ করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে লঞ্চগুলোতে আগুন ধরে যায় এবং নদীতে ডুবে যায়।
বোমা হামরায় লঞ্চে আগুন ধরায় ধোঁয়া তালতলী থেকে দেখা গিয়েছে লঞ্চগুলো ডুবে যাওয়ায় পাক সেনারা নদীর পশ্চিম পাড়ে ঠাকুরমল্লিক ও পূর্ব পাড়ে নন্দিরবাজারে উঠার চেষ্টা করে। এ সময় হাজার হাজার গ্রামবাসী ও মুক্তিবাহিনী ছুটে আসে। গ্রামবাসীরা গণপিটানি দিয়ে, কুপিয়ে এবং পানিতে চুবিয়ে পাকসেনাদের নিমর্মভাবে হত্যা করে। গ্রামের মহিলারাও ঝাড়ুদিয়ে পিটিয়ে মনের কষ্ট প্রশমিত করে। চারিদিকে সবাই বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ে।
৮ ডিসেম্বর উম্মত্ত দুঃশাসন মুছে নতুন করে বরিশালের সকল বাসভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়তে থাকে। স্বার্থক হলো ৮ মাস পূর্বে অর্থাৎ ২৫ এপ্রিল-৭১ প্রথম পাকবাহিনী বরিশাল আক্রমনকালে চরবাড়িয়া ইউনিয়নের ৪৭ জন শহীদদের জীবন দান ।
১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৩টায় ভারতীয় কমান্ডার প্রধান লে: জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা কোলকাতা ফোর্ট উইলিয়াম থেকে সস্ত্রীক হেলিকাপ্টারে তেজগাঁও বিমান বন্দরে অবতারণ করেন। গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে বিমানবহিনীর প্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ, কে,খন্দকার ঢাকায় আসেন। বিকেল ৪-৩১ মিনিটের সময় পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীর পক্ষে লেঃ জেনারেল এ, এ, কে, নিয়াজী আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করলেন। ইতি ঘটল এক নৃশংসতার। উম্মত্ত দু:শাসন মুছে নতুন পতাকা নিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন দেশ হিসেবে জন্ম নিল বাংলাদেশ। প্রায় শূন্য থেকে শুরু যে সশস্ত্র সংগ্রাম, তার সফল সমাপ্তি হলো মাত্র ন’মাসে। এমন নজীর পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এ ন’মাসের প্রত্যেকটি দিন ছিলো এক একটি ইতিহান-একটি বিস্ময়।